বেপরোয়া প্রেমঘোর পার্ট ৪

 বেপরোয়া_প্রেমঘোর 

লেখিকা—প্রিয়া(ছদ্মনাম)

পর্ব ৪


আদি একটা মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ব্রাশ করছে।ঘুম থেকে উঠেই সে শাওয়ার নিয়েছিলো।এখন নিচে বউভাতের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। হাতে একটা কালো ওয়াচ পড়ে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। পরক্ষণে কি মনে করে আবার আলমারির দিকে এগিয়ে আসলো।আলমারির ভেতর থেকে একটা প্যাকেট বের করে বিছানার উপর রেখে সে নিচে চলে গেল।আদিবা তখন শাওয়ার নিচ্ছে। 


নিচে আদির মা রিয়া চৌধুরী আর তাদের বাড়ির কাজের মহিলা রাহেলা বেগম রান্না করছেন। রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনা হলেও রাতে যেসব আত্মীয় স্বজনরা থেকে যাবেন তাদের জন্যই।আদি নিচে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলো তার কোনো হেল্প লাগবে কিনা!তিনি বললেন

—'রান্না শেষের দিকে আদি। আহামরি কোনো রান্না না।আমার হেল্প লাগবে না। কিন্তু আদিবা কোথায়? ও এখনো নিচে নামছে না কেন? একটু পরেই তো সবাই এসে পড়বে!'

—'আমি তো দেখে এলাম ও শাওয়ার নিচ্ছে মা।এসে পড়বে হয়তো।আমি বাইরে গেলাম। মামা-মামি আর অভিকে নিয়ে আসি। ওরা কাছেই এসে পড়েছে।'

—'ঠিক আছে সাবধানে যা।'


....


আদিবার গোসল করে এসে দেখলো খাটের উপর একটা প্যাকেট রাখা। পাশেই একটা নীল চিরকুট।আদিবা এগিয়ে গিয়ে চিরকুটটা হাতে নিয়ে দাঁড়ালো। সেখানের লেখাগুলো পড়তে শুরু করলো।


❝আগে থেকেই অনলাইনে অর্ডার করে এনে রেখেছিলাম এগুলো তোর বউভাতের জন্য। কিন্তু গাজরা আর চুড়িগুলো কিনতে পারিনি।তাই কাল রাতে বাইরে গিয়ে দেড় ঘন্টা খুঁজে খুঁজে একটা দোকান খোলা পেলাম। সেখান থেকে নিয়ে এসেছি।আজ এগুলো পড়িস।অনেক মানাবে তোকে।

—আদি❞


আদিবা হতভম্ব হয়ে রইলো।এই সামান্য গাজরা আর চুড়ি কিনতে কিনা তিনি ওত রাতে বাইরে গেছিলেন।মানুষটা তো বড্ড বেপরোয়া। আদিবা প্যাকেটটা নিয়ে বসলো।ভেতরে একটা গাঢ় গোলাপি রঙের শাড়ি, দুই ডকন চুড়ি আর একটা রজনীগন্ধার গাজরা। শাড়িটার উপর সোনালি রঙের জরি ও হালকা স্টোনের কাজ।আদিবার খুব পছন্দ হলো শাড়িটা।সে শাড়িটা পড়ে সাজতে বসলো।মাথার চুলগুলো খোপা করে তাতে গাজরা লাগিয়ে দিলো। হালকা মেকআপ ও চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিলো।দু হাত ভরে আদির দেওয়া চুড়িগুলো পড়ে নিচে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি রেডি হয়ে গেলো। 


আদি তার মামা মামি আর মামাতো ভাই অভিকে নিয়ে বাড়িতে এসেছে।অভি এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে।আদির সাথে তার বেশ ভাব।আদি তাদের বাড়ি নিয়ে এসে তার মাকে ডাকলো।

—'মা দেখো মামা মামিকে নিয়ে এসেছি। কোথায় তুমি? এদিকে এসো তাড়াতাড়ি। '

আদির মা হন্তদন্ত হয়ে এসে তার ভাই আফজাল হোসেনকে বললেন, 

—''ভাইয়া তুমি এসেছো।কেমন আছো ভাইয়া?ভাবি, অভি তোমরা কেমন আছো?'

—'আমরা সবাই ভালো আছি রিয়ু।তোরা কেমন আছিস? আর নতুন বউ কোথায়? তাকে দেখতেই তো আসা। সে এখনো এলো না কেন?'(আফজাল)

—'মামা ও তো রেডি হচ্ছে। এসে পড়বে হয়তো এক্ষুনি।'


আদি কথাটা বলতে না বলতেই কাঁচের চুড়ির ঝনঝন শব্দে সামনের দিকে তাকালো।তার চোখ আটকে গেলো সিড়ি দিয়ে নামতে থাকা ফুটফুটে মেয়েটির দিকে।যে মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই তার মন দখল করে বসে আছে।গাঢ় গোলাপি রঙের শাড়িটা আদিবাকে বেশ মানিয়েছে।


আদিবা নিচে নেমে সামনে এগিয়ে আসতেই আদির মা সবার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিলেন।

—'আসসালামু আলাইকুম মামা মামি আর ভাইয়া।কেমন আছেন আপনারা সবাই?'

মিষ্টি হাসি দিয়ে কথাটি বললো আদিবা।

—'ওয়ালাইকুম আসসালাম মা।আমরা সবাই ভালো আছি।তুমি ভালো আছো তো?'


সালামের জবাব দিয়ে আফজাল হোসেনের স্ত্রী মিনি হোসেন বললেন।


—'জি মামি আমিও ভালো আছি।আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন?বসুন।আর আমি খুবই দুঃখিত আগে থেকে এখানে উপস্থিত না থাকতে পারার জন্য!'(আদিবা)

—'আরে সমস্যা নেই মা। আমরা তো মাত্রই এলাম।'(আফজাল)

—'আপা এই বুঝি সেই ছোট্ট আদিবা।ওকে তো একদম ছোট বেলায় দেখেছিলাম।অনেক মিষ্টি হয়েছে তো দেখতে!দেখি মা এদিকে এসে বসো তো!'(মিনি)


আদির মামি আদিবাকে নিয়ে সোফায় বসলেন।তারপর একটা গিফট বক্স আদিবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

—'নেও মা এটা তোমার জন্য। আমাদের পক্ষ থেকে একটা ছোট্ট উপহার।'

—'এসবের কোনো দরকার ছিলো না মামি!'

—'আরে রাখো মেয়ে।অবশ্যই দরকার আছে।এত মিষ্টি একটা মেয়েকে গিফট না দিলে বরং অন্যায় হয়ে যাবে বুঝলে?দোয়া করি মা সারাজীবন আমাদের আদিকে নিয়ে সুখে থাকো।তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকেও দেখে রেখো মা!'

—'জি ইনশাআল্লাহ আমি আমার সবটুকু দিয়ে সবাইকে যত্নে রাখার চেষ্টা করবো মামি।'


আরো কিছু টুকটাক কথা বলে আদির মামা মামি উপরে চলে গেলেন তাদের রুমে।অভি নিচে রয়ে গেলো আদির সাথে ডেকোরেশনের কাজগুলো ঠিকঠাক ভাবে হচ্ছে কিনা দেখার জন্য। অভি বরাবরই তেমন কথা বলে না।প্রয়োজনীয় কথা বাদে তাকে তেমন একটা হইচই করতে দেখা যায় না।আদিবা তার শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে তার রুমে গেলো কথা বলার জন্য। আদি তো এতক্ষণ শুধু তাকেই দেখছিলো।চলে যাওয়াতে সে একটা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে হেঁটে চললো বাগানের দিকে।কিন্তু এতক্ষণ যে আদি বাদেও আরো একজোড়া চোখ আদিবার দিকে কিছুটা স্নিগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো তা কেউই টের পেলোনা।


____________________


অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে দুপুরে। আদির মামারা বাদে সকলে চলে গেছে দুপুরের পর পরই। আদিবা সবকিছু তার শ্বশুর ওসমান চৌধুরীর ঘরের দিকে চললো।তিনি আলাদা ঘরেই থাকেন। বেশিরভাগ সময় বই পড়েই কাটিয়ে দেন।প'ঙ্গুত্ব বরণ করার পর থেকে নিজেকে একা করে নিয়েছেন। অনেকবার বলেও তাকে নিজের রুমে আনতে পারেনি আদি আর রিয়া চৌধুরী। আদিবার বিয়ের দিন শুধু দোয়া করেছিলো আর আজ নিচে এসেছিলো।এই আদিবার সাথে তার দেখা।তাই আদিবা ওনার সাথে কিছু কথা কথা বলার জন্য তার রুমে পা বাড়ালো।


আদিবা ঘরে এসে দেখলো তিনি একটা বই বুকের উপর নিয়ে খাটের উপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।ঘুমোচ্ছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না।আদিবা একবার পুরো ঘরটায় চোখ বুলালো।এটাকে ঘর কম লাইব্রেরি বলা যায় বেশি।দুটো বড় বড় বুক সেল্ফ ঘরের দুই পাশে।সেখানে নানা রকম বই।আদিবা কয়েকটা বইয়ে হাত বুলালো।টেবিলের সাথে ধা'ক্কা খাওয়ায় শব্দতে ওসমান চৌধুরী চোখ খুলে তাকালেন।আদিবা ওনাকে তাকাতে দেখে বললো,

—'আসসালামু আলাইকুম চাচ্চু।স্যরি বাবা।কেমন আছেন?আপনার সাথে তো আমার তেমন কথা হয়নি তাই একটু কথা বলতে এসেছিলাম।ঘুম ভা'ঙানোর জন্য দুঃখিত বাবা।'


—'ওয়াআলাইকুম আসসালাম মা। আমি তো ঘুমাইনি।এমনি চোখ বন্ধ করে ছিলাম।এসো বসো এখানে।আমার সাথে তো তোমার তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই।বিজনেসের কাজের জন্য তুমি যখন এ বাড়িতে আসতে আগে তার বেশিরভাগ সময়টাই বাইরে থাকতাম।ভালো করেছো এসেছো।বসো আমরা একটু গল্প করি।'


আদিবা মিষ্টি হেসে ওনার পাশে বসতেই তিনি আদিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

—'আমি তো ভালো আছি মা।তুমি কেমন আছো? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো তোমার? '

—'না বাবা আমার কি সমস্যা হবে।আমিও ভালো আছি।'

—'বেশ মা।দোয়া করি সবসময় ভালো থাকো আর আমার ছেলেটাকে দেখে রাখো।দূর্ঘটনার পর থেকে কেন যেন নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হতো।লজ্জা লাগতো ওদের সামনে যেতে।তাই একাকিত্ব কেই বেছে নিয়েছিলাম।আর এখন সেভাবেই ভালো আছি।যদিও আমি জানি আমার ছেলে ও আমার স্ত্রী আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে তবুও নিজের যেন কেমন একটা লাগে তাদের সামনে থাকতে।'

—'বাবা আপনি কেন লজ্জা পাবেন!প'ঙ্গুত্ব তো কোনো লজ্জার বিষয় না বাবা।আপনি এভাবে ওদেরকে দূরে ঠেলে দিলে কি করে হবে বলুন।আপনি সবসময় আমাদের সাথে থাকবেন তাহলে আপনার আরো ভালো লাগবে।'

—'থাকতে তো চাই মা।কিন্তু এতদিন একা থাকার এখন যেন একাকিত্বটাই বেশি ভালো লাগে।বাদ দাও এসব।তুমি খেয়েছো মা?'

—'জি বাবা খেয়েছি।আপনি খেয়েছেন?আর আপনার ঔষধ? ঔষধ খেয়েছেন?'

—'দেখেছো মা একদম ভুলে গেছি খাওয়ার পর ঔষধ খেতে।টেবিল থেকে ঔষধ এর বক্সটা দাও তো মা।'

আদিবা বক্সটা হাতে নিতে নিতে বললো,

—'বাবা এভাবে ভুলে গেলে কিন্তু হবে না। এখন থেকে আমি প্রতিদিন আপনাকে ঠিক সময়মতো ঔষধ খাইয়ে দিয়ে যাবো।ঠিক আছে?নিন এখন ঔষধগুলো খেয়ে নিন।


আদিবা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো ওসমান চৌধুরীর দিকে।তিনি এক এক করে সবগুলো ঔষধ খেয়ে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিলেন আদিবার কাছে।

—'বাবা অনেক রাত হয়ে গেছে।আপনার এখন ঘুমিয়ে পড়া উচিত। আমি লাইট অফ করে দিয়ে যাচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।'

—'ঠিক আছে মা।তুমিও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।'


আদিবা ঘরের লাইট অফ করে দিলো।কিন্তু ঘর থেকে বেরুলো না।সে ভাবলো বাবাকে ঘুমোতে দেখে তারপর যাবে।অন্ধকারই দাঁড়িয়ে রইলো সে।কিছুক্ষণ পর ওসমান সাহেবের ঘন শ্বাস অনুভব করতে পেরে আদিবা চলে যেতে উদ্্যত হলো।কিন্তু দরজার কাছে যেতেই কিছুর শব্দ পেয়ে থমকে দাঁড়াল। কেমন একটা হাড় মড়মড় করে চি'বি'য়ে খাওয়ার শব্দ। আদিবার সন্দেহ হলো।সে ঘুরে দেখলো ওসমান সাহেব বিছানাতেই শুয়ে আছেন। অন্ধকারেও তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।আদিবা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে কনফার্ম হলো।শব্দটাকে মনের ভুল ভেবে সে চলে যেতে লাগলেই মেঝেতে কোনো তরলে পা পিছলে সে পড়ে গেলো।আদিবার বহু কষ্টে হাতে থাকা ফোনের ফ্লাশটা অন করে ধরতেই দেখতে পেলো তার আশপাশ জুড়ে র'ক্তের মাখামাখি। সে আঁতকে উঠল । ছাদের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেলো একটি কা'টা হাত পড়ছে উপর থেকে। আদিবা একটা বিকট চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো।


চলবে...


গল্প সম্পর্কে রিভিউ দিন 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

তুমি আসবে বলে পার্ট ১৩

আমার তোমার তোমাদের গল্প পার্ট ১

বেপরোয়া প্রেমঘোর পার্ট ২