বেপরোয়া প্রেমঘোর পার্ট ৫

 #বেপরোয়া_প্রেমঘোর 

লেখিকা— #প্রিয়া(ছদ্মনাম) ( Priya's Story ) 

#পর্ব_৫


আদির ঘরে খাটের উপর অচেতনভাবে শুয়ে আছে আদিবা।পাশেই টুলের উপর আদিবার হাত ধরে চিন্তিত ভঙ্গিতে তার মুখপানে চেয়ে আছে আদি।চোখজোড়া তার টকটকে লাল।কান্না আটকানোর ফল হয়তো!আদির মা ও এখানেই আছেন।মামা-মামি একটু আগেই নিজেদের ঘরে গেলেন।অভি একবার দেখেই চলে গেছে।আদিবার পুরো কপাল জুড়ে ব্যান্ডেজ।ব্যান্ডেজের উপরেও র'ক্তের দাগ স্পষ্ট। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে একদম।কিছুক্ষণ আগে আদির বাবার ঘরে আদিবার চিৎকারে তিনি ঘুম থেকে জেগে যান।খাটের পাশেই সুইচ বোর্ড হওয়ায় বাতি জ্বালিয়ে তিনি দেখতে পান আদিবা এলোমেলো ভাবে মেঝেতে পড়ে রয়েছে।আদিবার কপালের একপাশে যেখানে আগে থেকেই ব্যান্ডেজ করা ছিলো সেটা খুলে গিয়ে র'ক্ত পড়ছে। আদিবাকে এমন অবস্থায় দেখে ওসমান সাহেব ভীষণ ভয় পেয়ে যান।তিনি জোরে জোরে আদিকে আর রিয়া চৌধুরীকে ডাকতে থাকেন।বাবার চিৎকার শুনে ড্রয়িং রুমে বসে থাকা আদি দৌড়ে তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।পিছু পিছু যান আদির মা ও।আদি গিয়ে আদিবার এই অবস্থা দেখে পা'গ'লপ্রায় হয়ে যায়।সে আদিবাকে কোলে করে তার ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।তারপর ডাক্তারকে কল করলে তিনি এসে ট্রিটমেন্ট করে যান।


আদির মা বললো,

—'আদি তুই শুয়ে পড়।আমিও যাচ্ছি।ওকে তো ঘুমের ঔষধ দিয়েছে বোধ হয়। এত তাড়াতাড়ি জাগবে না।'

—'তুমি যাও মা।এত রাত পর্যন্ত জেগে আছো এমনিতেই।এখন একটু না ঘুমালে তোমার শরীর খারাপ হবে। আমার আর আজ ঘুম হবে না।ওর হঠাৎ করে কোনো অসুখ না থাকা সত্ত্বেও এমন কেন হলো আমি তো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। একটা জায়গায় কতবার আঘাত পাচ্ছে মেয়েটা মা।আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে ওকে এভাবে দেখতে।চোখমুখ কেমন শুকিয়ে গেছে দেখো!'

—'শান্ত হ আদি।ওর হয়তো এমনিতেই মাথা ঘুরে গেছিলো তাই এমন হয়েছে। তুই আর চিন্তা করিস না। ঠিক হয়ে যাবে সব। সকালে উঠলে আমি ওকে বেশি বেশি করে খাওয়াবো।দেখবি চোখমুখ আর শুকনো দেখা যাবে না।'

—'মা তুমি আমার সাথে মজা করছো?'

—'আরে না।মজা কেন করবো।আমি তো সত্যি বলছি।ও তো এমনিতেই অনেক শুকিয়ে গেছে ওর বাবা মা'রা যাওয়ার পর।এখন ওকে বেশি বেশি করে খাওয়াবো। দেখবি ২ দিনেই কেমন চনমনে হয়ে উঠে।তুই আর চিন্তা করিস না বাপ।শুয়ে পড়।আমিও গেলাম ঘরে।আমার কেমন লাগছে যেন।'

—'হ্যাঁ মা তুমি যাও।নাহলে আবার তোমারও ওর মতো অবস্থা হবে। যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আর বাবাকেও চিন্তা না করে ঘুমিয়ে পড়তে বলো। '

—'ঠিক আছে বলবো।তুইও ঘুমিয়ে পড়।'


আদির মা বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।আদি উঠে দরজা লাগিয়ে দিয়ে আদিবার পাশে হেলান দিয়ে বসলো।আদিবার হাতদুটো ধরে মনে মনে বললো,

—'তোর হঠাৎ করে কি হলো রে পাখি।এমন অঘটন কি করে ঘটালি বলতো।তাও আবার আমি সেদিন যেখানে ব্যথা দিয়েছিলাম সেখানেই আবার ব্যথা পেয়েছিস।অনেক কষ্ট হয়েছে তাই না?আমার যে তোর কষ্ট একদম সহ্য হচ্ছে না।তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আমার সাথে কথা বল।নাহলে আমি শান্তি পাবো না রে।'


আদি খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বোজার সাথে সাথেই টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে।কারো সামনে কান্না করতে না পারায় কান্না আটকে এখন মাথা ও গলা উভয়ই ভীষণ ব্যথা করছে আদির।কিন্তু মনের ব্যথার কাছে এই ব্যথা নিতান্তই তুচ্ছ। সেখানে যদি চোখের সামনে পড়ে থাকে ব্যথিত প্রিয়তমা তাহলে তো আর কথাই নেই।আদি এতক্ষণ আদিবার হাত মুঠোয় পুড়ে রেখেছিলো।হঠাৎ করে সে আদিবার হাতের নড়চড় অনুভব করলো।চোখ মেলে দেখলো আদিবা কেমন চোখ পিটপিট করছে আর হাত-পা নাড়াচ্ছে।মনে হচ্ছে ঘুমের মধ্যে কোনো ভয়ানক কিছু দেখেছে।হুট করেই আদিবা 'বাঁচাও' বলে চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো।আদি হকচকিয়ে সাথে সাথে তাকে জড়িয়ে ধরলো।আদিবাও আঁকড়ে ধরলো আদিকে।তার শরীর এখনো থরথর করে কাঁপছে। আদি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—'কি হয়েছে আদিবা?ভয় পেয়েছিস কিছু দেখে?কোনো ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছিস?কিরে কথা বল!'

—'স্বপ্ন নয় মিষ্টি করলা। আমি সত্যি দেখেছি।বাবার ঘরে কিছু ছিলো আমি সেটা দেখেই অজ্ঞান হয়েছিলাম।'


আদি সাথে সাথে বুক থেকে আদিবার মাথা তুলে তাকে জিজ্ঞেস করলো,

—'বাবার ঘরে দেখেছিস মানে!কি দেখেছিস বাবার ঘরে?কি দেখে অজ্ঞান হয়েছিলি বল?'

—' আমি জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না।বলবেন এটা আমার মনের ভুল।আমিও তো প্রথমে তাই ভেবেছিলাম কিন্তু মনের ভুলে তো দুবার এমন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে পারে না তাই না?'

—'আদিবাকে তুই আমাকে আগে বল কি ঘটেছে। কি এমন দেখেছিস যে তুই এভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলি।'

—'আমি বাবাকে ঔষধ খাইয়ে লাইট অফ করে দিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম বাবা ঘুমিয়েছে টের পেলে তারপর আসবো।কিছুক্ষণ পরই বাবা ঘুমিয়ে পড়েন।তারপর আমি বের হতে গেলে হঠাৎ কেমন হাড় চি'বা'নোর শব্দ পাই। পিছনে ফিরে বাবার কাছে গিয়ে দেখি বাবা ঘুমিয়ে আছেন।মনের ভুল ভেবে আবার চলে যেতে নিলেই আমি পা পিছলে মেঝেতে পড়ে যাই।তখন টেবিলের সাথে মাথার ধা'ক্কা লেগেছিলো।আমি অনেক কষ্টে ফোনের ফ্লাশ অন করে দেখি...'

আদিবা উত্তেজিত হয়ে পড়লো বলতে বলতে।তার শরীর থেকে তখন ঘাম ঝরছে।এখনো থরথর করে কাঁপছে সে। আদি আদিবাকে নিজের সাথে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

—'ভয় পাস না। আমি আছি তো।তারপর কি হয়েছিলো বল তো।'

—'তারপর.. তারপর আমি ফ্লাশের আলোতে দেখতে পাই আমার চারপাশে অনেক র'ক্ত।ভড়কে গিয়ে সিলিং এর দিকেই নজর পড়তেই দেখি একটা কা'টা হাত আমার উপর পড়ছে।তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।বিশ্বাস করুন আমি যা বলছি সবটা সত্যি। এত বড় ঘটনা কি করে মনের ভুল হতে পারে বলুন আপনি!'

—'হুম বুঝেছি।ঠিক আছে আমি তোর কথা বিশ্বাস করেছি।তুই আর বাবার ঘরে যাস না।যখন যেতে ইচ্ছে হবে আমাকে সাথে নিয়ে যাবি।আমি বাসায় না থাকলে যাবি না।আর এতো ভয় পাস না।আমি আছি না?আমি থাকতে তোর কোনো ক্ষতি হতে দেবো না।আজকের পর তোকে আর চোখের আড়ালই করবো না আমি।ভয় পাবি না একদম। শুধু ভাববি তোর আদি তোর সাথে আছে।'

—'আপনি বাড়িতে আমার সাথেই কিছুদিন থাকুন না প্লিজ মিষ্টি করলা। আমার নাহলে একা একা ঘরে থাকতেও ভয় করবে।'

—'আচ্ছা ঠিক আছে।আমি বাড়িতে একদম তোর সাথেই থাকবো সবসময়।কিন্তু তুই তখন থেকে আমাকে এটা কি বলে ডাকছিস?মিষ্টি করলা...!মানে কি এটা?তুই আমাকে এসব বলছিস কেন?'

আদিবা কিছুটা হেসে উঠলো আদির কথা শুনে।সে দুষ্টুমি করে বললো,

—'কেন আপনিই তো কাল বলেছিলেন আপনাকে আমি ভাইয়া বাদে যেকোনো নামে ডাকতে পারি।তাই আমি এই নামটা দিয়েছি। মিষ্টি করলা! কি সুইট একটা নেম না?'

—'সুইট না তো কচু।ছি ছি ছি! তোর মাথায় আর কোনো নাম আসলো না?শেষে কিনা মিষ্টি করলা? করলা কোনোদিন মিষ্টি হয়?এই উদ্ভট নামটা কি করে তোর মাথায় এলো রে?আশ্চর্য! '

—'দোখুন নামটা খুবই সুইট।আপনি শুধু শুধু এটাকে উদ্ভট বলছেন কেন?আর করলা মিষ্টি হয়না তো কি হয়েছে!আমি আপনার মধ্যে সেইরকম স্বভাবই দেখেছি।এই যেমন প্রথম দিন কিছু না জেনে কি চোটপাট করলেন আমার উপর।আমি তো ভেবেছিলাম আমার কপালে বুঝি হিরো না জুটে ভিলেন জুটেছে। ওমা!কিছুক্ষণ পর দেখি আবার নিজেই কি সুন্দর করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন।আবার চুল ব্রাশও করে দিলেন।মানে এই তিতে তো এই মিষ্টি এমন মানুষ আপনি। সচরাচর এমন মানুষ দেখা যায় না।এজন্য আমি আপনাকে এই আনকমন নামটা দিয়েছি। '

—'ঠিক আছে। দিয়েছিস যখন তাহলে আর কি করার আছে। কিন্তু দয়া করে কোনো আত্মীয় বা আমার কোনো বন্ধুর সামনে এই নামে ডাকিস না। তাহলে আমার মানসম্মান সব যাবে।আর সেদিন ওমন একটা কাজ করার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।আমাকে ক্ষমা করে দে প্লিজ!'

—'আরে আপনি আবার পুরনো কথা তুলছেন কেন?আমি তো সেদিনই বলেছি যে আমি কিছু মনে করিনি।আমি জানি আপনি রেগে গিয়েছিলেন সেজন্য ওমন করেছেন। তবে আপনার নাম আমি বদলাতে পারবো না।মিষ্টি করলা বলেই ডাকবো।'


খিলখিল করে হেসে উঠলো আদিবা।আদি সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো।কিছুক্ষণ পর আদিবার হাসি থামতে সে বলে উঠলো,

—'ঠিক আছে তুই যখন আমাকে এই নামে ডেকে এত আনন্দ পাচ্ছিস তখন এই নামেই ডাকিস।আমার কোনো আপত্তি নেই। তোর আনন্দ, তোর খুশিটাই আমার কাছে বড় বিষয়। '


কথাটুকুতে কি ছিলো আদিবা জানে না।কিন্তু সে খুব শান্তি অনুভব করলো।সে আদির বুকে আরো গুটিশুটি হয়ে মুখ লুকালো।আদিও কিছু না বলে আদিবাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো।হোকনা একটা রাত স্মরণীয়। প্রিয়তমাকে বুকে নিয়ে ঘুমানোর মতো প্রশান্তি পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার।কয়জনের এই আশা পূরণ হয়?আদিবার ঘন নিশ্বাসের শব্দ পেয়ে কিছুক্ষণ পর আদিও ওভাবেই হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।


_____________________


সকালে ঘুম ভা'ঙতেই নিজেকে আদির বুকে দেখতে পেলো আদিবা।কিঞ্চিত লজ্জার রেখা ফুটে উঠলো তার মুখে।আদি তাকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে যে সরে যাওয়ারও উপায় নেই।আদিবা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ৯ টা বেজে গেছে।সে আদিকে মৃদু ধা'ক্কা দিয়ে বললো, 

—'শুনছেন?৯ টা বেজে গেছে।আর কতো ঘুমাবো।আমাকে একটু ছাড়ুন।আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে যাবো।আমি থাকা সত্ত্বেও মাকে একা একা কাজ করতে হচ্ছে। রাহেলা খালা তো আর রান্নার কাজ করবে না।কাল বড় অনুষ্ঠান ছিলো বলে একটু সাহায্য করেছে। মা একা এতজনের রান্না করতে পারেন?দেখি আমাকে ছাড়ুন তো।এই?আপনি শুনতে পাচ্ছেন না?উঠুন না!'

আদিবা এবার বেশ জোড়েসড়ে ধা'ক্কা দিলো আদিকে। আদিকে হকচকিয়ে ঘুম থেকে জেগে গেলো। আদিবাও মুক্ত হয়ে গেছে তার হাতের বাঁধন থেকে।আদি জিজ্ঞেস করলো, 

—'কি হয়েছে এত ডাকাডাকি করছো কেন?আরেকটু ঘুমাতাম।কাল তো অনেক রাত করে ঘুমিয়েছি।

—'তো আপনি ঘুমান।না করেছে কে?আমি নিচে যাবো।মা একা একা এত কাজ করতে পারেন না।'


নিজের মার প্রতি আদিবার এতো কনসার্ন দেখে আরেক দফা মুগ্ধ হলো আদি।এখন তো ঘরে ঘরে বউ শ্বাশুড়ির যুদ্ধই চলে বেশি।কোথাও শ্বাশুড়ি বউয়ের উপর ছু'ড়ি ঘোরায় আর কোথাও বউ শ্বাশুড়ির উপর। দুজনের এমন বন্ধুত্ব কয়টা সংসারে দেখা যায়?আদির নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো।কারণ তার মা ও আদিবাকে যেমন ভালোবাসে আদিবাও তার মাকে তেমনই ভালোবাসে।অন্তত বউ শ্বাশুড়ির দ্বন্দ্বে তাকে আর পড়তে হবে না।মুচকি হেসে উঠলো আদি....!


(রিচেক করা হয়নি।ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)


চলবে...?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

তুমি আসবে বলে পার্ট ১৩

আমার তোমার তোমাদের গল্প পার্ট ১

বেপরোয়া প্রেমঘোর পার্ট ২