বেপরোয়া প্রেমঘোর পার্ট ৭

বেপরোয়া_প্রেমঘোর 

লেখিকা—প্রিয়া(ছদ্মনাম)


পর্ব ৭

ডক্টর সীমার কেবিনে তার সামনে বসে আছে আদি আর আদিবা। তিনি একজন নামকরা সাইক্রিয়াটিস্ট। আদিবাকে এখানে নিয়ে এসেছে আদি আজ সকালেই।ডক্টর সীমা তার চোখের চশমাটা এক হাত দিয়ে ঠেলে উপরে তুলে আদিবার দিকে তাকালেন।আদিবাকে দেখে মধ্যবয়স্কা সীমার মনে মায়া জাগলো।বিয়ে করলে তার নিজেরও এমন একটা সন্তান থাকতো। তিনি নরম স্বরে আদিবাকে জিজ্ঞেস করলেন,

—'মিসেস চৌধুরী! বলুন আপনার কি সমস্যা? সব খুলে বলবেন। কিছু বাদ রাখবেন না প্লিজ।তাহলে আমারই ট্রিটমেন্ট করতে সমস্যা হবে।'


আদিবা এসব বলার কথা শুনে আরো গুটিয়ে গেলো।কাঁপতে শুরু করলো। চোখমুখে বিরাজ করলো ভয়ংকর অস্থিরতা। সে অস্থির হয়েই আদিকে বললো,

—'আমাকে এখান থেকে প্লিজ নিয়ে চলুন।আমি কিচ্ছু বলতে পারবো না।আমার ভয় করছে।প্লিজ আমাকে এসব মনে করাবেন না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন প্লিজ।'


চেয়ার থেকে উঠার জন্য হাত পা ছুঁ'ড়তে শুরু করলো আদিবা।আদি তাকে দু হাতে জাপটে ধরে রেখেছে।ডক্টর সীমা অবস্থা বেগতিক দেখে আদুরে স্বরে বললেন,

—'মিসেস চৌধুরী! বি কুল প্লিজ। আপনাকে ওসব বলতে হবে না।আমি তো আপনার নামটাই জানি না।আপনার নামটা বলুন প্লিজ। '

আদিবা কিছুটা শান্ত হয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিজেকে বললো,

—'আমার নাম আদিবা। আপনি আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হবো।'

—'ওকে ওকে আদিবা। তুমি করেই বলছি।দেখো আদিবা কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য আমি এখনো বিয়ে করিনি আর ভবিষ্যতেও করবো না। আমি যদি বিবাহিত হতাম তবে আমার অবশ্যই তোমার মতো একজন সন্তান থাকতো। তার এমন অবস্থায় আমি একজন ডক্টর হয়ে নিশ্চয়ই হাত পা গুটিয়ে বসে থাাকতাম না!দেখো আমি জানি আমি তোমার অপরিচিত। তুমি আমাকে তোমার ততটা আপন মনেও করছো না। কিন্তু আমার কিন্তু তোমাকে বেশ ভালো লেগেছে আদিবা।তোমার মুখেই কেমন যেন একটা মায়া মায়া ভাব।তোমাকে নিজের কাছের কেও মনে করেই আমি তোমার চিকিৎসাটা করতে চাই। আর এজন্য আমাকে সবকিছু জানতে হবে।তুমি এখন সেসব বলতে ভয় পাচ্ছো।আমি যতদূর শুনলাম তোমার মা এখন গ্রামে আছেন।আচ্ছা তুমি ভেবে দেখো এমন পরিস্থিতিতে তিনি যদি তোমার কাছে থাকতেন তবে কি তুমি সবার আগে তার কাছে ছুটে গিয়ে তোমার সাথে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো বলতে না?ওনাকে একটা ভরসাস্থল মনে হতো না তোমার? বলো?'

—'জি...জি ম্যাম।তাই করতাম আমি।'


ডক্টর সীমা এবার নিজের চেয়ারটা টেনে আদিবার পাশে নিয়ে এসে বসলেন।আদিবার মাথায় হাত রেখে আদুরে স্বরে বললেন, 

—'মা তুমি আমাকে আন্টি বলেই ডাকতে পারো।আমাকে কিছু মুহূর্তের জন্য নিজের মা মনে করে সব কথাগুলো বলো না।আই প্রমিস ইউ!তোমার সব সমস্যার সমাধান আমি করে দেবো।এখন সেটা তোমার হ্যালুসিনেশন হোক বা প্যারানরমাল সামথিং। তুমি প্লিজ সাহস করে সব বলো মা। আমি তোমার হাসবেন্ড আমরা তোমার পাশেই আছি।কিচ্ছু হবে না তোমার। '


ডক্টর সীমা একহাতে খানিকটা জড়িয়ে ধরলেন আদিবাকে।আদিবার উপর তার এমনিতেই মায়া কাজ করছে।তাছাড়া এখন তিনি যা বলছেন বা করছেন তা একজন পেশেন্টের ভয় কা'টানোর জন্য যথেষ্ট। তবে তিনি আদিবাকে নিজের মনে করেই একটু এক্সট্রা সাহস দিচ্ছেন। আদিবা একটা বড়সড় ঢোক গিললো।বারকয়েক শ্বাস নিয়ে সে বলা শুরু করলো একে একে তার সাথে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা। সব কথা শুনে ডক্টর সীমার কপাল কুঁচকে গেলো।আদি কাল রাতের ঘটনাটা জানতো না কারণ আদিবা ভয়ে কাওকেই কিছু বলেনি।রাতের ঘটনা শুনে তার নিজেরও অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। ডক্টর সীমা কিছুটা চিন্তিত হয়ে ভাবলেন হ্যালুসিনেশন যদি হয়েই থাকে তবে ধা'ক্কাটা কিসের ছিলো।হ্যালুসিনেশনে সব দৃশ্যমান হয় কিন্তু কিছু অনুভব করা যায় না। কিন্তু কাল যে আদিবা বেশ জোরে ধা'ক্কা খেয়ে ছিটকে পড়েছিলো তার প্রমাণ হিসেবে তার মাথার একপাশে ভয়ংকর রকম নীল হয়ে ফুলে আছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্ষতের উপর আবার তাজা ক্ষত।সীমা আগে টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে করতে বললেন,

—'মিঃ চৌধুরী! আদিবার সমস্যাটা বেশ গুরুতর। আর আপনারা ওর ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করেননি কেন?'

—'কি করে করবো ম্যাম।আমি বাড়িতে গিয়ে দেখি মা,মামি মিলে কোনোমতে ওর জ্ঞান ফিরিয়েছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে ও কাউকে পাশেই যেতে দিচ্ছে না। কেও গেলেই চেঁচিয়ে উঠছে। আমিও কাছে যেতে পারিনি।শেষে অনেক কষ্টে এক প্রকার জোড় করেই আপনার কাছে নিয়ে এসেছি ম্যাম।'

—'ওকে ইট'স ওকে।আমি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি।আর ওর ট্রিটমেন্টটা আমি এখনই দিতে পারছিনা। কারণ ওর কেসটা খুব ডিফিকাল্ট।আমাকে পুরো বিষয়টি নিয়ে স্টাডি করতে হবে।মিঃ চৌধুরী আপনি কাল সকাল ১০ টার দিকে নাহয় আমার চেম্বারে একআার আসবেন।আমি সব বুঝিয়ে দিবো।এখন আমি ওকে ভয়মুক্ত হওয়ার জন্য আর মেন্টাল রিফ্রেশমেন্টের জন্য কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি। এগুলো আপাতত খাওয়ান।আর ওকে একদমই একা রাখবেন না।একা থাকা ওর জন্য খুবই ভয়ংকর হবে এখন।বুঝতে পেরেছেন?'

—'জি ম্যাম। আমি এমনিতেও ওকে আর একা রাখতাম না। যাই হোক আমি কাল এসে যাবো।আপনি প্লিজ চেষ্টা করবেন ওকে যেন সম্পূর্ণভাবে এসব থেকে বের করে আনা যায়।থ্যাংক ইউ সো মাচ ম্যাম।'

—'ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম মিঃ। এন্ড আদিবা!মা তুমি নিজের খেয়াল রেখো।আর আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো।আমি তোমার প্রবলেম সল্ভ করে দেবো ইনশাআল্লাহ। টেক কেয়ার ওকে।'

—'জি আন্টি। ধন্যবাদ আপনাকে।'

—'ম্যাম আমরা তাহলে আসি।আমি কাল ঠিক সময়েই এসে পড়বো।নাও গুড বায়।'

—'ওকে ওকে।টেক কেয়ার অফ হার!'


আদি আদিবাকে নিয়ে উঠে এলো।তবে কেবিন থেকে বের হওয়ার আগে ডক্টর সীমার দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিলো আদি।


___________________


—'কু*** বাচ্চা। তোর এত বড় সাহস যে আমার খেয়ে আমার পড়ে তুই আমার মুখের উপর কথা বলিস!আমার সাথে দুর্ব্যবহার করিস।নিজের বাবার সাথে?তোকে আমি আজ মে'রেই ফেলবো জা****। এতে যা হয় হবে।'

কথাগুলো শেষ করে আরেকটা বেল্টের আঘাত করলেন আফজাল হোসেন অভির পিঠে।ওসমান সাহেব ও নিচে এসে অনেকবার বারণ করেছেন। কিন্তু আফজাল যেন আজ নিজের মধ্যেই নেই।মিনি এসে তাকে থামানোর চেষ্টা করলে তিনি মিনিকেও ধা'ক্কা দিয়েছেন।ভয়ে রিয়া চৌধুরী আর এগোন নি।মিনি ওনাকে জাপটে ধরে কান্না করছেন।বাড়িতে পা ফেলার সাথে সাথেই ড্রয়িং রুমে এমন বিভৎস দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ালো আদি আর আদিবা।অভিকে আবার মা'রতে উদ্যত হতেই আদিবাকে দরজায় রেখেই ভেতরে ছুটলো আদি। শক্ত করে ধরে ফেললো নিজের মামার হাতটি। অভির সাদা শার্টের বেশ কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গিয়ে লাল লাল দাগগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।আফজাল হোসেন হুংকার দিয়ে বললেন,

—'আমাকে ছেড়ে দে আদি। ছাড় আমায়।এই জা****কে আজ আমি মে'রেই ফেলবো।ও আমাকে গালিগালাজ করে।তুই ভাবতে পারছিস আদি কত বড় নিমোকহারাম ও?'

—'মামা...মামা প্লিজ শান্ত হও।কি হয়েছে আগে আমায় বলো।ছেলেটার অবস্থা কি করেছো দেখেছো?ছেলেটা তো ম'রে যাবে মামা।তুমি এদিকে এসে বসো।বসে শান্ত হও মামা প্লিজ।'


আদি দুহাতে জড়িয়ে বহু কষ্টে আফজালকে সোফায় এনে বসালো।তার হাত থেকে বেল্টটা নিয়ে ছুঁ'ড়ে ফেললো।রিয়াকে বললো আদিবাকে নিয়ে উপরে যেতে।ওর এসবে থাকা উচিত নয়।রিয়া চৌধুরীও দৌড়ে আদিবার কাছে গেলেন।আস্তে আস্তে ধরে তাকে নিজে ঘরে নিয়ে গেলেন।আদি এবার অভির কাছে গেলো। বেচারার ঠোঁট কে'টে র'ক্ত পড়ছে। অভিকে ধরে উঠানোর চেষ্টা করলো আদি।কিন্তু অভি কোনোভাবেই নিজের পায়ের উপর ভর দিতে পারলো না।শেষে মিনি এগিয়ে এলেন।সন্তানের এমন দৃশ্য কার সহ্য হয়।যতই হোক সন্তান তো।তিনি অভিকে খুব ভালোবাসেন।দুজনে ধরে ধরে অভিকে বহু কষ্টে সোফার অপর প্রান্তে বসালো।মিনি তার পাশে বসলেন যাতে আফজাল উঠে আবার তার ওপর আ'ক্র'ম'ণ করতে না পারে।আফজাল এখন নীরবভাবে রাগে ফুঁসছেন। আদি এবার আফজালের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—'মামা এবার বলো।সমস্যাটা কি?ঠিক কোন অপরাধে এমন জা***রের মতো আচরণ করলে অভির সাথে। আনসার মি মামা!'

আদি কিছুটা চিৎকার করেই বলে উঠলো।আফজাল হোসেন এবার একটু নড়েচড়ে বসে বললেন,

—'ওর কোন বন্ধু বান্ধবের সাথে নাকি ও কোথায় ঘুরতে যাবে।সেজন্য আমার কাছে ২ লাখ টাকা চেয়েছে।আমি এখন ২ লাখ টাকা কোথায় পাবো বল?আমার ব্যবসায় এখন লস হচ্ছে শুধু। সেই নিয়ে চিন্তায় আছি কিভাবে চলবো।আর ও এদিকে ফালতু কাজের জন্য এত টাকা চায়!আমি দিতে পারবো না বলেছি বলে আমাকে, নিজের বাবাকে ও যা নয় তাই বলে গালিগালাজ করেছে।কিসব অকথ্য ভাষায় কথা বলেছে আমার সাথে তুই ভাবতে পারবি না আদি।এমনি এমনি কেও নিজের ছেলেকে এভাবে মা'রে বল?তোরাই ভেবে দেখ ও কি আচরণ করেছে যার জন্য আমি এমন করেছি।'


আদি এবার অভির দিকে তাকিয়ে বললো,

—'কি রে?মামা যা যা বলছে সব কি সত্যি? তুই মামাকে গালিগালাজ করেছিস?'


কা'টা ঠোঁট নিয়ে বলতে কষ্ট হলেও অভি বললো,

—'হ্যাঁ সত্যি।আমি ওনাকে গালিগালাজ করেছি।কিন্তু ওনি তো সবটা বলেননি।আমি যখন টাকা চেয়েছি তখনই ওনি আমাকে যদি বুঝিয়ে বলতেন যে ব্যবসায় লস যাচ্ছে। ওনি এখন টাকা দিতে পারবেন না।তবে কি আমি এমন করতাম?আদি তোর মনে হয় আমি এমনি এমনি গালি ইউজ করতে পারি?ওনি টাকা চাওয়ার সাথে সাথেই রীতিমতো গালি দিয়েই আমাকে বলে যাচ্ছিলেন যে ওনি টাকা দিতে পারবেন না। আমার মাথা গরম হয়ে গেছিলো। সেজন্যই আমিও বলে ফেলেছি। আর দেখ এখন আমার কি অবস্থা। বলি তোরা আমায় কেন বাঁচালি রে ভাই?ম'রে যেতাম।ভালো লাগে না আমার এ দুনিয়া।সবকিছু বিষাদ লাগে।হুহ!'

আদি বললো,

—'দেখো তোমাদের কাকে কি বলবো আমি বুঝতে পারছি না।আমার সত্যিই কিছু বলার নেই।তবে আমি শুধু এটুকুই চাইবো বাবা ছেলে নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নাও।ব্যাপারটাকে আর বাড়তে দিও না।মামি আর মামা প্লিজ তোমরা দুজনে মিলে অভিকে ঘরে নিয়ে শার্টটা চেন্জ করিয়ে দাও।এভাবে চোখের সামনে একজনকে আমি ম'রতে তো দিতে পারবো না।আমি মুখটা ধুয়ে আসছি।হসপিটাল নিয়ে যাবো ওকে।'


গটগট পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো আদি।আর মনে মনে বললো,

—'অভি তো খুব শান্তশিষ্ট একটা ছেলে।এমন ভোলাভালা ছেলেটা কিনা নিজের বাবাকে গালিগালাজ করেছে?এতটা বদলে গেছে ও?বিশ্বাসই হচ্ছে নাহ।'


চলবে...?


(গঠনমূলক মন্তব্য করবেন প্লিজ।) 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

তুমি আসবে বলে পার্ট ১৩

আমার তোমার তোমাদের গল্প পার্ট ১

বেপরোয়া প্রেমঘোর পার্ট ২